দুর্যোগ বিডি
অতি বৃষ্টিজনিত বন্যা কেন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা
বাংলাদেশ, একটি নদীমাতৃক দেশ, যেখানে প্রায় ৮০০টিরও বেশি নদী প্রবাহিত। তবে, এই নদীগুলোর আশীর্বাদ কখনো কখনো অভিশাপে পরিণত হয়, বিশেষত যখন অতি বৃষ্টিপাত ঘটে। অতি বৃষ্টিজনিত বন্যা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটি দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ এবং সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে। এর ফলে প্রতিবার দেশের লাখো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফসল নষ্ট হয়, এবং বাসস্থান হারিয়ে যায়।
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারনে বন্যার সৃষ্ট হয়েছে- যেটি ছবিতে দেখানো হয়েছে |
অতি বৃষ্টিজনিত বন্যা কী?
অতি বৃষ্টিজনিত বন্যা বলতে এমন একটি অবস্থাকে বোঝায় যেখানে বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয় এবং তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটে। এই বন্যা সাধারণত হঠাৎ দেখা দেয় এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়।
অতি বৃষ্টির ফলাফল
- পানি জমে যাওয়া এবং প্লাবন।
- নদীগুলোর জলস্তর বৃদ্ধি।
- শহর ও গ্রামে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি।
- নিচু এলাকার মানুষের বাড়িঘর ও ফসল ধ্বংস।
অতি বৃষ্টিজনিত বন্যার কারণ
১. মৌসুমি বৃষ্টি ও বর্ষাকাল
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বর্ষাকালে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। এই মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে প্রতি বছর দেশের নদীগুলো পানিতে ভরে যায় এবং অনেক সময় তা পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্লাবন সৃষ্টি করে।
- বর্ষাকালে জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২০০০-৩০০০ মি.মি।
- পাহাড়ি এলাকা এবং নদী সংলগ্ন এলাকায় এই সময় বন্যার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।
২. নদী ও হিমালয় থেকে আসা পানির চাপ
বাংলাদেশের উত্তরে অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালা থেকে পানির প্রবাহ দক্ষিণে আসে। যখন ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তখন হিমালয় থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত পানি দেশের নদীগুলোতে যোগ হয়। এর ফলে, তীরবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয়।
৩. শহরের অব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা
বড় শহরগুলোতে পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হলে তা দ্রুত নিষ্কাশন করা সম্ভব হয় না।
- ঢাকার মতো বড় শহরে রাস্তাঘাট ডুবে যায়।
- আবাসিক এলাকা পানির নিচে চলে যায়।
- জীবিকা নির্বাহের সুযোগ কমে যায়।
অতি বৃষ্টিজনিত বন্যার প্রভাব
১. কৃষি খাতে ক্ষতি
বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে কৃষিনির্ভর। কিন্তু বন্যার কারণে দেশের প্রধান ফসল ধান, পাট এবং সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়।
- মাঠের ফসল পানির নিচে চলে যায়।
- কৃষকরা আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়।
- খাদ্য সংকট দেখা দেয়, বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে।
উদাহরণ
২০২০ সালের সুনামগঞ্জের বন্যায় প্রায় ৫০ হাজার একর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছিল।
২. গৃহহীনতা এবং মানবিক বিপর্যয়
অতি বৃষ্টিজনিত বন্যার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে। লাখো মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়।
- গৃহহীন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়।
- পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
- বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র হয়।
৩. পরিবেশগত প্রভাব
- জলাবদ্ধতার কারণে ভূমির উর্বরতা নষ্ট হয়।
- নদীর পাড় ধসে গিয়ে আশপাশের এলাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ে।
অতি বৃষ্টিজনিত বন্যার উদাহরণ
২০০৪ সালের বন্যা
২০০৪ সালের বন্যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ। দেশের প্রায় ৬০% এলাকা প্লাবিত হয়েছিল।
- প্রায় ৪ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
- শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়।
- আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন টাকা।
২০১৭ সালের সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা
সুনামগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে অতিবৃষ্টির ফলে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল।
- প্রায় ৭০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- শহর ও গ্রাম এলাকায় অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছিল।
- বাঁধ ভেঙে হাওর অঞ্চলের ফসল পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছিল।
কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
১. বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ
বন্যা প্রতিরোধের জন্য বাঁধ নির্মাণ অন্যতম কার্যকরী পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক বাঁধ সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কার্যকারিতা হারায়।
- নদীর পাড়ে টেকসই বাঁধ তৈরি করা।
- বাঁধের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
২. ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন
নগর এবং গ্রামীণ এলাকায় উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
- ভারী বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- নগর পরিকল্পনায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
৩. আধুনিক প্রযুক্তি ও পূর্বাভাস ব্যবস্থা
বন্যা মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
- স্যাটেলাইট এবং রাডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার পূর্বাভাস বাড়ানো।
- পানির গতিপ্রবাহ ট্র্যাকিং করে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া।
৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
- বন্যার সময় করণীয় সম্পর্কে প্রচারণা চালানো।
- স্কুল-কলেজে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ দেওয়া।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অতি বৃষ্টির সংযোগ
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের প্যাটার্ন পরিবর্তিত হয়েছে।
- অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে।
- বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এই পরিবর্তনের জন্য বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
সমাধান:
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
- কার্বন নিঃসরণ কমানো।
- টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা।
FAQs
১. অতি বৃষ্টিজনিত বন্যার প্রধান কারণ কী?
মৌসুমি বৃষ্টি, হিমালয় থেকে পানির প্রবাহ, এবং জলবায়ু পরিবর্তন।
২. বাংলাদেশের কোন অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
সিলেট, সুনামগঞ্জ, এবং দক্ষিণাঞ্চলের নিম্নভূমি অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. বন্যা প্রতিরোধে প্রযুক্তির ভূমিকা কী?
স্যাটেলাইট ও রাডার প্রযুক্তি বন্যার পূর্বাভাস দিতে সহায়তা করে।
৪. বন্যার ফলে কৃষিতে কী ধরনের ক্ষতি হয়?
ধান, পাট এবং সবজির মতো ফসল ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়।
৫. অতি বৃষ্টি কমানোর জন্য কী করা যেতে পারে?
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ।
৬. এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কী?
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ, বাঁধ নির্মাণ, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
আমাদের পেজটি সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছিল ১৭/১২/২০২৪। আপনি আমাদের শর্তাবলী মেনে নিয়েছেন।
0 Comments