খরা কি, সংজ্ঞা এবং খরা কে কিভাবে মোকাবিলা বা প্রতিরোধ করা যায় তার উপায়

D urjogbd.top-এ স্বাগতম! এটি একটি শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট, যেখানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ সম্পর্কে তথ্য শেয়ার করা হয়। দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমার গ্র্যাজুয়েশন অভিজ্ঞতার আলোকে, আমি চেষ্টা করছি দুর্যোগের কারণ, প্রস্তুতি, এবং পরবর্তী সময়ে টিকে থাকার কৌশল সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে তৈরি এই প্ল্যাটফর্মে, আমি আমার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। কারণ, প্রস্তুতি ও সচেতনতা বাঁচাতে পারে জীবন। ধন্যবাদ!


খরা কি, খরার ১০ টি সংজ্ঞা, খরা প্রতিরোধের উপায় (What is drought, definition and prevention way)

আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব খরা সম্পর্কে। আপনি একটি বিষয় জানলে অবাক হবেন যে বিভিন্ন সেক্টর এ খরা কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং সব খরা কে আক ভাবে আপনি প্রতিরোধ করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে বিভিন্ন factor কাজ করে। সুতরাং খরার সময় preparation নিতে গেলে আগে আপনাকে বুঝতে হবে আপনি কোন ধরনের খরা মোকাবিলা করতে চাচ্ছেন। 
বিষয়টি একটু জটিল হয়ে গেল, চলুন পোস্ট টি পরলে ভাবভাবে বুঝতে পারবেন।

খরা কী? ( What is Drought)

খরা (Drought) এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা দীর্ঘ সময় ধরে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে মাটি, পানি, এবং জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। খরার ফলে ফসলহানি, পানির অভাব, এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়।

  ২

খরার ১০ টি সংজ্ঞা (The 10 definition of the Drought)

চলুন আমরা আবার আরও একটু ভালভাবে জেনে আসি , খরা (Drought) কি এবং খরা সম্পর্কে বিশ্বের বড় বড় সংস্থা কিভাবে তথ্য প্রদান করেছে। এমনকি একেক সংস্থা একেক ভাবে খরার সংজ্ঞা প্রদান করেছে। আমি আশা করছি এইবার আপনি আরও ভালভাবে বুঝতে পারবেন খরা সম্পর্কে। নিচে খরার ১০টি সংজ্ঞা (Ten definition of Drought) এবং এদের উৎস উল্লেখ করা হলো:

জাতিসংঘ (UN):

"খরা হল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়, যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়।"
উৎস: UNCCD

বিশ্বব্যাংক (World Bank):

"খরা একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত ও পানির সরবরাহ কমে যায়।"
উৎস: World Bank Reports

ইউনাইটেড স্টেটস ড্রট মনিটর:

"খরা একটি ধীরগতির দুর্যোগ যা কয়েক সপ্তাহ বা বছরের জন্য পানি সরবরাহের ঘাটতি তৈরি করে।"
উৎস: US Drought Monitor

FAO:

"খরা হল একটি আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ, যা প্রধানত কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।"
উৎস: FAO Reports


IPCC:

"খরা হল এমন একটি অবস্থা যেখানে বৃষ্টিপাতের দীর্ঘস্থায়ী অভাব, উচ্চ তাপমাত্রা এবং নিম্ন আর্দ্রতার কারণে ভূমি শুকিয়ে যায়।"
উৎস: IPCC Climate Change Report
খরা কি, খরার ১০ টি সংজ্ঞা, খরা প্রতিরোধের উপায় (What is drought, definition and prevention way), খরা বাংলাদেশ,
এটি একটি কৃষি খরা (Agricultural Drought); যেখানে চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত পানি বা বৃষ্টিপাতের অভাব

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর:

"বাংলাদেশে খরা বলতে এমন সময়কে বোঝায়, যখন স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০% বা তার বেশি বৃষ্টিপাতের ঘাটতি হয়।"
উৎস: BMD (Bangladesh Meteorological Department)


NASA:

"Drought is a period of drier-than-normal conditions that results in water-related problems."
উৎস: NASA Earth Science

World Meteorological Organization (WMO):

"খরা মানে দীর্ঘমেয়াদী শুষ্ক অবস্থা যেখানে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ থাকে না।"
উৎস: WMO Reports

Environmental Protection Agency (EPA):

"খরা হল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা পানির ঘাটতি এবং কৃষি উৎপাদনে ক্ষতির কারণ হয়।"
উৎস: EPA Guidelines

UNICEF:

"Drought is one of the leading causes of water scarcity, impacting millions of lives globally."
উৎস: UNICEF Water Reports


সুতরাং আপনি এতক্ষণ এ বুঝে ফেলেছেন যে, খরা শব্দটি বিভিন্ন ফিল্ড এ বিভিন্ন রকম। একজন কৃষিবিদ এর কাছে খরা বলতে যা বুঝায়  একজন hydrologist এর কাছে সেটি ভিন্ন হবে। এখন কৃষিবিদ খরা তখন বলবেন যখন চাষাবাদ এর জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাব হবে আর একজন hydrologist চিন্তা করবেন যখন আমাদের বিশুদ্ধ পান করার পানির লেভেল কমে যাবে বা water table ডাউন হবে।

    ৩

বাংলাদেশে খরার বাস্তব উদাহরণ (The real examples of drought in Bangladesh)

বাংলাদেশে খরার বাস্তব উদাহরণ

  1. রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চল:

    ২০১০ সালে রাজশাহী ও রংপুরে বৃষ্টিপাতের অভাবে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাপমাত্রার বৃদ্ধি এবং পানির ঘাটতির কারণে ধানের উৎপাদন ৪০% কমে যায়।
  1. পাবনা জেলার খরা:

    ২০২২ সালে পাবনায় দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে কৃষকদের সেচের পানির অভাব দেখা দেয়, যা শাকসবজি ও ফলের উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
 ৪

বিশ্বব্যাপী খরার উদাহরণ (The world's drought examples)

বিশ্বব্যাপী খরার উদাহরণ

  1. ইথিওপিয়া (Ethiopia):
    ২০১৫ সালে ইথিওপিয়ায় তীব্র খরার কারণে ১০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ খাদ্যসংকটে পড়ে।

  2. অস্ট্রেলিয়া:
    ২০১৯ সালে "Black Summer" এর সময় অস্ট্রেলিয়ার খরার কারণে বড় ধরনের বুশফায়ার হয় এবং পানির ঘাটতি দেখা দেয়।

  3. ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র:
    ক্যালিফোর্নিয়ায় ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত খরা চলাকালে পানির সংকটের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি হয়।

  4. ভারত:
    মহারাষ্ট্রে ২০১৯ সালে মারাঠাওয়াড়ায় খরার কারণে কৃষি উৎপাদন ৫০% হ্রাস পায় এবং অনেক কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।

 ৫

খরা প্রতিরোধের উপায় (How to prevent the drought)

খরা প্রতিরোধের উপায়

খরা (Drought) একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রভাব ফেলে মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষি, পরিবেশ, এবং অর্থনীতিতে। এটি প্রতিরোধে নানা ধরণের কৌশল ও প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব চর্চা, এবং স্থানীয় জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খরার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ করতে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যা পরিস্থিতি অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে।

বাংলাদেশে খরার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষত রাজশাহী ও রংপুরে। খরার ফলে শস্য উৎপাদন হ্রাস, পানির সংকট এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে খরা মোকাবিলার জন্য স্থানীয় জ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্থানীয় কৃষকরা মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে জৈব সার ব্যবহার করেন। সেচের জন্য "শ্যালো টিউবওয়েল" এবং ক্ষুদ্র পুকুরের ব্যবহারও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী খরা প্রতিরোধের জন্য উন্নত দেশগুলো উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রয়োগ করে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েল তাদের ড্রিপ ইরিগেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি পানির অপচয় রোধ করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে 'রেইনওয়াটার হারভেস্টিং' পদ্ধতি ব্যবহার করে পানির ঘাটতি পূরণ করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে, খরা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানির পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও বিশ্বের মধ্যে খরা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পার্থক্য প্রধানত প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে উদ্ভূত। বাংলাদেশে খরার ক্ষেত্রে স্থানীয় জ্ঞান ও কম খরচের পদ্ধতির উপর নির্ভরশীলতা বেশি। উদাহরণস্বরূপ, কৃষকরা খরাপ্রবণ অঞ্চলে কম পানি-নির্ভর শস্য, যেমন কাউন ও গম চাষ করেন। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার খরার প্রভাব কমাতে বেশি কার্যকর।

খরা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কৌশল (Effective techniques of prevention the Drought)

খরা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কৌশল হলো:

  1. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য পুকুর খনন ও পুনঃখনন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। আফ্রিকায় একই উদ্দেশ্যে বিশাল জলাধার নির্মাণ করা হয়।
  2. বনায়ন ও গাছপালা রোপণ: মাটির আর্দ্রতা রক্ষায় বনাঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
  3. সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন: উন্নত সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে পানির অপচয় কমিয়ে আনা সম্ভব। ভারত ও বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে ড্রিপ ইরিগেশন প্রযুক্তি ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়।
  4. স্থানীয় জ্ঞান ব্যবহার: স্থানীয় আদিবাসীদের পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি খরা মোকাবিলায় দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশে ২০১০ সালে রাজশাহীতে খরা প্রতিরোধে ক্ষুদ্র জলাধার তৈরি করা হয়েছিল, যা স্থানীয় কৃষি উৎপাদন বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার খরা ব্যবস্থাপনার জন্য পানি সংরক্ষণ ও পুনঃব্যবহারের উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করে।

খরা প্রতিরোধে সফল হতে হলে স্থানীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, এবং পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির মেলবন্ধন ঘটানো জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করলে খরার ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।


উৎস:

  1. UNCCD (United Nations Convention to Combat Desertification)
  2. FAO (Food and Agriculture Organization)
  3. বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর
  4. IPCC Climate Change Report
  5. স্থানীয় কৃষি গবেষণা প্রতিবেদন
  6. UNICEF
  7. NASA
  8. World Bank

আমাদের পেজটি সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছিল ২০/১১/২০২৪। আপনি আমাদের শর্তাবলী মেনে নিয়েছেন।


Post a Comment

0 Comments