বাংলাদেশে খরা: কি, কারণ, প্রকারভেদ, প্রভাব, সমাধান এবং বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
১. খরার সংজ্ঞা
খরা হলো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা দীর্ঘ সময় ধরে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ার ফলে পানি সংকট তৈরি করে। এটি মাটি, জলাধার এবং পরিবেশের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। বাংলাদেশে খরা সাধারণত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজশাহী, রংপুর এবং বারিন্দ অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
২. বাংলাদেশে খরার কারণ
বাংলাদেশে খরার মূল কারণগুলো হলো:
জলবায়ু পরিবর্তন: বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে খরা বেড়ে চলেছে।
নদী এবং জলাশয়ের শুকিয়ে যাওয়া: শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোর পানি কমে যাওয়া এবং জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া খরার প্রধান কারণ।
অতিরিক্ত পানির ব্যবহার: কৃষি ও শিল্প খাতে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ভূগর্ভস্থ স্তরকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
বনাঞ্চল ধ্বংস: বন ধ্বংসের ফলে পরিবেশের শীতলীকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, যা খরার প্রবণতা বাড়ায়।
উদাহরণ: বারিন্দ অঞ্চলে বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে।
৩. খরার প্রকারভেদ
আবহাওয়াগত খরা: স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত। যেমন, ২০১৯ সালে রংপুর অঞ্চলে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০% কম বৃষ্টি হয়েছিল।
কৃষিজ খরা: মাটিতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় ফসল উৎপাদনে সমস্যা হয়। ধান ও গমের ক্ষতির প্রধান কারণ এই ধরণের খরা।
হাইড্রোলজিক খরা: নদী, পুকুর, এবং জলাশয়ে পানির ঘাটতি। যেমন, পদ্মা নদীর শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে যাওয়া।
সামাজিক-অর্থনৈতিক খরা: পানি সংকটের কারণে মানুষের জীবনে আর্থিক ও সামাজিক প্রভাব পড়ে।
৪. খরার প্রভাব
(ক) কৃষিতে প্রভাব
ধান, গম, ভুট্টার মতো ফসলের উৎপাদন কমে যায়।
উদাহরণ: ২০২২ সালে রাজশাহীতে খরার কারণে ধানের উৎপাদন ২০% কমে গিয়েছিল।
(খ) পরিবেশে প্রভাব
গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং বন্যপ্রাণী খাদ্য ও পানির অভাবে কষ্ট পায়।
পুকুর, নদী ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(গ) অর্থনীতিতে প্রভাব
ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্য সংকট এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দেয়।
(ঘ) সামাজিক প্রভাব
পানি সংকট এবং খাদ্যের অভাবে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসিত হয়।
উদাহরণ: রাজশাহী ও নাটোর থেকে অনেক মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকায় চলে যায়।
৫. বাংলাদেশে খরা মোকাবিলা
(ক) পানির সংরক্ষণ
পুকুর খনন, খাল পুনর্খনন, এবং জলাধার তৈরি করে পানি সংরক্ষণ করা।
উদাহরণ: রাজশাহীর একটি প্রকল্পে ৫০০টিরও বেশি পুকুর পুনর্খনন করা হয়েছে।
(খ) খরা-সহনশীল ফসল চাষ
BRRI Dhan 56 এবং BINA Dhan 8 এর মতো ফসল চাষ করা যেতে পারে।
(গ) বনায়ন
খরাপ্রবণ এলাকায় গাছ লাগানোর মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা।
(ঘ) প্রযুক্তি ব্যবহার
ড্রিপ ইরিগেশন এবং খরা পূর্বাভাস প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
উদাহরণ: সেচ ব্যবস্থায় সোলার পাম্পের ব্যবহার।
৬. বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরার ঘটনা বাড়ছে। ২০২৩ সালে বারিন্দ অঞ্চলে খরার প্রভাব খুবই তীব্র ছিল। ভবিষ্যতে আরও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
0 Comments