বাংলাদেশের খরাঃ খরা অর্থ, কত বার খরা হয়েছে, খরা প্রবণ জেলা কয়টি, খরার প্রকারভেদ, খরা কেন হয়, বাংলাদেশ এ খরা দুর্ভিক্ষ ও খরা মোকাবিলায় করনীয়
উদাহরণস্বরূপ, 2014 সালে খরার সময়, রাজশাহী শহরের কৃষি উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং স্থানীয় কৃষকদের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপরন্তু, খরা জলাধার, পুকুর এবং টিউবওয়েল শুকিয়ে যেতে পারে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। খরা মোকাবেলায় জল সংরক্ষণ, সেচ ব্যবস্থার উন্নতি এবং খরা-প্রবণ এলাকায় খরা-সহনশীল ফসল প্রবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে খরা বাংলাদেশের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি।
বাংলাদেশে কত বার খরা হয়েছে?
বাংলাদেশ বহুবার খরার সম্মুখীন হয়েছে, তবে বিশেষ করে 1979, 1981, 1982, 1989 এবং 1994 সালে গুরুতর খরা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল 1979 সালের খরা, যা বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রভাবিত করেছিল। এই খরা কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে এবং খাদ্য নিরাপত্তা সংকট তৈরি করে।1979 খরা দেশের প্রায় 42% কৃষি জমি ধ্বংস করে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ফেলেছিল। উপরন্তু, 1994 সালের খরা উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর জেলায় পানির ঘাটতি এবং কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। জলবায়ু পরিবর্তন, অসম বৃষ্টিপাত এবং দুর্বল সেচ ব্যবস্থার কারণে এই খরা হয়। বাংলাদেশের মতো কৃষি-নির্ভর দেশগুলিতে খরা একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা, যা জীবিকা ও অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের খরা প্রবণ জেলা কয়টি?
বাংলাদেশের খরা প্রবণ জেলা মূলত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত এবং এর সংখ্যা প্রায় ১২টি। এই জেলাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, এবং পঞ্চগড়। এসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির তীব্র সংকট দেখা যায়।উদাহরণস্বরূপ, রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা খরার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেখানে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং নদী, পুকুর ও জলাধারগুলো প্রায় শুকিয়ে যায়। ২০১০ সালের দিকে এই এলাকাগুলোতে খরার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, কৃষকদের বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপ থেকে পানি উত্তোলন করতে হয়েছিল। এই খরা প্রবণ জেলাগুলোতে সেচব্যবস্থা উন্নতকরণ, খরাপ্রতিরোধী শস্যের চাষ, এবং জল সংরক্ষণের মতো টেকসই সমাধান গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
খরা কত প্রকার ও কি কি?
খরা সাধারণত তিন প্রকারের হয়, যা প্রভাব ও কারণ অনুসারে বিভক্ত। এই প্রকারগুলো হলো:মৌসুমি খরা: এটি তখন ঘটে যখন নির্দিষ্ট সময়ে
বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয়। বাংলাদেশে বর্ষাকালে বৃষ্টি কম হলে, বিশেষ করে
উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে, মৌসুমি খরার সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালে রাজশাহী
অঞ্চলে মৌসুমি খরা দেখা গিয়েছিল, যা আমন ধানের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়।
কৃষি খরা: যখন মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকে
না, এবং এর ফলে ফসল চাষ সম্ভব হয় না, তখন তাকে কৃষি খরা বলা হয়। এটি প্রধানত দীর্ঘ
সময় ধরে বৃষ্টিপাতের অভাব ও সেচব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে হয়। উত্তরবঙ্গের অনেক এলাকায়
কৃষি খরা একটি সাধারণ সমস্যা।
হাইড্রোলজিকাল খরা: এটি তখন ঘটে যখন নদী,
পুকুর, জলাশয়, এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর শুকিয়ে যায়। সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি খরার
কারণে এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, তিস্তাসহ উত্তরাঞ্চলের ছোট নদীগুলো
শুষ্ক মৌসুমে হাইড্রোলজিকাল খরার মুখোমুখি হয়।
বাংলাদেশে এই তিন ধরনের খরাই কখনও এককভাবে,
আবার কখনও সমন্বিতভাবে ঘটে থাকে, যা কৃষি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
খরা হয় কেন
খরা হওয়ার প্রধান কারণ হলো বৃষ্টিপাতের ঘাটতি এবং দীর্ঘ সময় ধরে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করা। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হলেও কিছু মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ এবং পরিবেশগত পরিবর্তন খরার মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।- বৃষ্টিপাতের অভাব: যখন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে মৌসুমি বা বার্ষিক বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয়, তখন খরার সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বর্ষাকালে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে খরা দেখা দেয়।
- জলবায়ু পরিবর্তন: বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টির স্বাভাবিক সময়সূচি ও পরিমাণে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, যা খরার কারণ।
- অপরিকল্পিত সেচ ও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার: কৃষি উৎপাদনে অতিরিক্ত সেচ এবং ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে জলাধারগুলো শুকিয়ে যায়, যা খরার ঝুঁকি বাড়ায়।
- বন উজাড়: বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায় এবং স্থানীয় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা খরাকে আরও তীব্র করে তোলে।
- নদীর প্রবাহ হ্রাস: আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি প্রত্যাহার বা নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ অনেক কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলে খরার প্রকোপ বেড়েছে।
এইসব কারণের সমন্বয়ে খরা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যা কৃষি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবনযাত্রার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল কত সালে?
বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যভাবে দুটি বড় দুর্ভিক্ষের কথা ইতিহাসে আলোচিত হয়। একটি হলো ১৯৪৩ সালের বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষ, এবং অন্যটি হলো ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষ।১৯৪৩ সালের বঙ্গীয় দুর্ভিক্ষ: এই দুর্ভিক্ষ ব্রিটিশ ভারতের সময় ঘটে এবং তৎকালীন বাংলার একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করে। এর ফলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বন্যা, যুদ্ধকালীন খাদ্য সংকট, এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষ: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষটি ঘটে ১৯৭৪ সালে। এর প্রধান কারণ ছিল ১৯৭৪ সালের বন্যা, যা দেশের খাদ্য উৎপাদনকে ধ্বংস করে। সেই সময় খাদ্য সরবরাহের ঘাটতি, মূল্যবৃদ্ধি, এবং প্রশাসনিক ত্রুটির ফলে লাখো মানুষ অনাহারে মারা যায়।
এই দুর্ভিক্ষগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্য মজুদ, বন্যা মোকাবিলা, এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অবহেলা নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।
খরা মোকাবেলায় করণীয় কি কি?
খরা মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি কৃষি, পানি সরবরাহ এবং মানুষের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে খরা মোকাবেলায় নিচের করণীয়গুলো কার্যকর হতে পারে:- সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন: আধুনিক এবং টেকসই সেচ ব্যবস্থা চালু করা, যেমন ড্রিপ ইরিগেশন এবং স্প্রিংকলার ব্যবহার, খরা প্রবণ এলাকায় ফসল উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে।
- খরাপ্রতিরোধী শস্য চাষ: খরা সহনশীল ধান, গম, ভুট্টা এবং অন্যান্য ফসলের জাত চাষ করে খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) খরাপ্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে।
- বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ: খরা মোকাবিলার জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। পুকুর, জলাধার, এবং চেক ড্যাম নির্মাণ এই কাজে সহায়ক।
- বনায়ন বৃদ্ধি: গাছ লাগানোর মাধ্যমে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখা এবং স্থানীয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, যা খরা প্রতিরোধে সহায়ক।
- জলবায়ু সহনশীল পরিকল্পনা: খরাপ্রবণ এলাকাগুলোর জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ, যেমন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, খাদ্য মজুদ ব্যবস্থা এবং বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টি।
- গভীর নলকূপ ও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ: অত্যধিক পানি উত্তোলন বন্ধ করে সেচের জন্য বিকল্প উৎস ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: খরার প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা এবং পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ।
0 Comments