খরার ১০ টি কারণ এবং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ কেন খরার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?

D urjogbd.top-এ স্বাগতম! এটি একটি শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট, যেখানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ সম্পর্কে তথ্য শেয়ার করা হয়। দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমার গ্র্যাজুয়েশন অভিজ্ঞতার আলোকে, আমি চেষ্টা করছি দুর্যোগের কারণ, প্রস্তুতি, এবং পরবর্তী সময়ে টিকে থাকার কৌশল সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে তৈরি এই প্ল্যাটফর্মে, আমি আমার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। কারণ, প্রস্তুতি ও সচেতনতা বাঁচাতে পারে জীবন। ধন্যবাদ!

খরা কেন হয় ও এর ১০ টি কারনঃ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ খরার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন? 

1

খরা কেন হয় এবং খরার ১০টি কারণ

খরা হলো এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাতের অভাবে পানি সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করে। এটি পরিবেশের ওপর যেমন প্রভাব ফেলে, তেমনি অর্থনীতি, কৃষি ও মানবজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে খরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।

খরা এর ১০ টি কারনঃ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ খরার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
খরার কারণে মাটির ফাটল সৃষ্টি হয়েছে

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বিশেষত রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে খরার প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। খরার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর মধ্যে প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট উভয় প্রভাব রয়েছে।

  1.  বৃষ্টিপাতের অভাব (Lack of Rainfall): দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত না হলে মাটির আর্দ্রতা কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার কারণে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট)।
  2.  বায়ুমণ্ডলীয় উচ্চচাপ (Atmospheric High Pressure): বায়ুমণ্ডলে উচ্চচাপ বেশি হলে মেঘ গঠন বাধাগ্রস্ত হয় এবং বৃষ্টি হয় না।
  3.  বনভূমি ধ্বংস (Deforestation): বাংলাদেশের সুন্দরবনসহ অন্যান্য বনভূমি ধ্বংসের কারণে খরার প্রকোপ বেড়েছে। বন ধ্বংসের ফলে আর্দ্রতার স্তর কমে যায় এবং জলবায়ুর ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে (তথ্যসূত্র: FAO রিপোর্ট ২০২৩)।
  4. জলবায়ু পরিবর্তন (Climate Change): বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সাহারা মরুভূমি অঞ্চলে খরার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে (তথ্যসূত্র: IPCC রিপোর্ট ২০২1)।
  5. পানি ব্যবস্থাপনার অভাব (Poor Water Management): সেচ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও জলাধার সংকট কৃষিক্ষেত্রে খরার প্রভাব বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, তিস্তায় পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সেচ কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড)।
  6. মাটির আর্দ্রতা হ্রাস (Soil Moisture Depletion): অতিরিক্ত চাষাবাদে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পাচ্ছে, যা খরার অন্যতম কারণ।
  7.  শিল্পকারখানা বৃদ্ধি (Industrial Expansion): শিল্পকারখানা থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে।
  8.  জনসংখ্যা বৃদ্ধি (Population Growth): অধিক জনসংখ্যার কারণে পানির চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে জনসংখ্যার চাপের কারণে পানির প্রাপ্যতা সংকট সৃষ্টি হয়েছে (তথ্যসূত্র: UN Water Report)।
  9. নদীর গভীরতা কমে যাওয়া (River Depletion): নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া যেমন তিস্তায় ঘটছে, তা খরার অন্যতম কারণ।
  10.  গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ (Greenhouse Gas Emission): পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের ঘনত্ব কমে যাচ্ছে, যা খরা সৃষ্টি করছে (তথ্যসূত্র: UN Climate Change Report ২০২২)।

বিশ্বের উদাহরণ হিসেবে ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে এক ভয়াবহ খরা দেখা গিয়েছিল, যা কৃষিতে বিপুল ক্ষতি করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ২০১৬ সালে উত্তরাঞ্চলে খরা ধান উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছিল। 

2

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ খরার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন?

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ খরার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়াগত পরিবর্তন, এবং মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ। এই অঞ্চলে খরার প্রভাব মূলত কৃষি, পানি সরবরাহ, এবং মানুষের জীবনযাত্রার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। নিচে বিস্তারিতভাবে এই অঞ্চলের খরাপ্রবণতার কারণগুলো ব্যাখ্যা করা হলো:

১. ভৌগোলিক অবস্থান

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ মূলত সমতল ভূমি এবং তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর ওপর নির্ভরশীল। এই অঞ্চলে নদীগুলোর পানিপ্রবাহ বর্ষাকালে বাড়লেও শুষ্ক মৌসুমে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও বাঁধের কারণে তিস্তার পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা শুষ্ক মৌসুমে খরার ঝুঁকি বাড়ায়।

২. বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা

উত্তরবঙ্গে প্রতিবছর গড় বৃষ্টিপাত দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে, বৃষ্টিপাতের অভাবে এই অঞ্চলের মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালের খরার সময় বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার কারণে শস্য উৎপাদনে বড় ধরনের ক্ষতি হয়।

৩. নদীর পানিপ্রবাহ হ্রাস

তিস্তা, ধরলা, এবং অন্যান্য ছোট নদীগুলোর পানিপ্রবাহ শুষ্ক মৌসুমে প্রায় শুকিয়ে যায়। এর ফলে কৃষিতে সেচের পানি সংকট দেখা দেয়। তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ হ্রাসের জন্য তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের প্রভাব এবং উজানের দেশ থেকে পানির সরবরাহে বাধা অন্যতম কারণ।

৪. মাটির গঠন ও আর্দ্রতার ঘাটতি

উত্তরবঙ্গের মাটি বেলে ধরনের হওয়ায় এতে পানি ধারণক্ষমতা কম। এর ফলে বৃষ্টিপাত কম হলে মাটি দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং কৃষি কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

৫. জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ছে এবং বৃষ্টিপাতের সময় ও ধরণে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। ফলে উত্তরবঙ্গে খরার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

৬. অপর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা

এই অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও, শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। গভীর নলকূপ এবং খাল-নদীর পানি সেচের জন্য যথেষ্ট নয়।

৭. মানবসৃষ্ট কার্যকলাপ

বনভূমি ধ্বংস, অত্যধিক কৃষিকাজ, এবং পানির অপচয়ও খরার সমস্যা বাড়িয়ে তোলে।

3

রংপুর এর খরার একটি বাস্তব চিত্র

২০১৬ সালে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে তীব্র খরার কারণে ধান ও গমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একইভাবে, ১৯৮২ এবং ২০১০ সালের খরার সময় এই অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

উত্তরবঙ্গের খরাপ্রবণতা মোকাবিলার জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, উন্নত সেচ ব্যবস্থা, এবং আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি কার্যকর করার ওপর জোর দেওয়া উচিত।

4

খরা কিভাবে কৃষির উপর প্রভাব ফেলে

খরা কৃষির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা খাদ্য উৎপাদন, কৃষকের জীবনযাত্রা, এবং অর্থনীতিতে বিশাল সংকট সৃষ্টি করে। যখন দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাতের অভাব হয়, তখন মাটির আর্দ্রতা কমে যায় এবং শস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। মাটি শুষ্ক হয়ে যাওয়ায় ফসলের বৃদ্ধি থেমে যায়, এবং অনেক ক্ষেত্রেই চাষকৃত ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।

খরা কেন হয় ও এর ১০ টি কারনঃ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ খরার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন? খরা কিভাবে কৃষির উপর প্রভাব ফেলে?


বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ২০১০ সালের খরা একটি বাস্তব উদাহরণ। রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে দীর্ঘ সময় বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে কৃষকরা আমন ধানের চাষ করতে পারেনি। মাটিতে আর্দ্রতার অভাব এবং পানির উৎস শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৩০% কমে গিয়েছিল।

একটি বাস্তব চিত্র হিসেবে ধরা যাক, একটি কৃষক পরিবারের কথা। রংপুরের এক কৃষক, আব্দুল করিম, যিনি ২ একর জমিতে ধান চাষ করেন। খরার সময় বৃষ্টির অভাবে তার জমি চাষের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। সেচের জন্য গভীর নলকূপ ব্যবহার করতে গিয়ে তার উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু ফলন এত কম হয় যে তার ঋণ শোধ করাও সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায়, তার পরিবার খাদ্য সংকটে পড়ে এবং তাকে জমির একটি অংশ বিক্রি করতে হয়।

বিশ্বব্যাপীও খরার প্রভাব একই রকম। ২০১9 সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে খরার কারণে গম ও বার্লি উৎপাদনে ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। দেশটির কৃষি রপ্তানি ২০% কমে গিয়েছিল, যা অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।

খরা কৃষিতে প্রভাব ফেলে শুধু খাদ্য উৎপাদন কমিয়ে নয়, বরং জীববৈচিত্র্য, প্রাণিসম্পদ, এবং কৃষি-নির্ভর শিল্পেও ক্ষতি করে। তাই এই সমস্যার সমাধানে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, খরাপ্রবণ ফসলের চাষ, এবং জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতির প্রয়োগ প্রয়োজন।

5

খরার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

খরার কারণে শুধু কৃষি নয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও যে দীর্ঘমেয়াদী সংকট সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, খরা কীভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অভিবাসন বাড়ায় এবং শহুরে এলাকায় জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি করে।

6

খরার প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার

খরাপ্রবণ অঞ্চলে পানি সংরক্ষণ, সেচ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, এবং খরাপ্রতিরোধী ফসল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে তা নিয়ে লেখা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে সৌরচালিত সেচ পাম্পের ব্যবহার।


তথ্যসূত্র:

  1. FAO Report 2023
  2. IPCC Climate Change Report 2021
  3. বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (BWDB)
  4. UN Climate Change Report 2022
  5. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
  6. FAO, ২০২৩ রিপোর্ট
  7. UN Climate Change Report, ২০২১


আমাদের পেজটি সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছিল ২6/১১/২০২৪। আপনি আমাদের শর্তাবলী মেনে নিয়েছেন।

Post a Comment

1 Comments

  1. অনেক হেল্পফুল একটি ওয়েবসাইট। দুর্যোগের সকল তথ্য খুব সুন্দর & গোছালো অবস্থায় পাওয়া যায়।

    ReplyDelete